বর্তমান সময়ে চুলের সমস্যায় ভুগতে দেখা যায় অধিকাংশ মানুষকে। নারী হোক কিংবা পুরুষ কম বেশি সবাই চুল পড়ার মতন সমস্যার সম্মুখীন হন। শীতের সময়ে এই সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করে। আবহাওয়ার তারতম্যজনিত কারণে শীতের সময়ে চুল পড়তে শুরু করে।চুল পড়ার পাশাপাশি চুল রুক্ষ হয়ে যায়, স্ক্যাল্পে দেখা দেয় খুশকি। খুশকির কারণেও চুল ঝরতে থাকে এ সময়। চুল ভঙ্গুর হলে সমস্যা আরো জটিল হয়ে যায়। তাই চুল যদি মজবুত এবং স্বাস্থ্যকর হয়, চুলা পড়া স্বাভাবিকভাবেই অনেকাংশে কমে আসে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে সহজেই চুলের এ সকল যাবতীয় সমস্যা দূর করা সম্ভব। চুলের যাবতীয় সমস্যা মোকাবেলায় সঠিক খাবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চুলের যত্নে ডায়েট হতে হবে সঠিক এবং ব্যালান্সড। ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করতে এমন খাবার যেগুলো চটজলদি চুলের সমস্যা দূর করবে।
আসুন চুলের জন্য উপকারী নিউট্রিয়েন্ট সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক ----
বায়োটিন
অনেকেই জানেন বায়োটিন চুল পড়া রোধে কাজ কাজ করে। পাশাপাশি খুশকি প্রতিরোধ করে চুলের বৃদ্ধিতে কাজ করে এমন ভিটামিন সমূহের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন হচ্ছে বায়োটিন। বায়োটিনের খুবই উল্লেখযোগ্য খাদ্য উৎস হচ্ছে ডিমের কুসুম। এছাড়া ব্রকলি, ফুলকপি, মিষ্টি আলু, কলা, অ্যাভোকাডো, বিভিন্ন বীজ, বাদাম থেকে যথেষ্ট পরিমাণে বায়োটিন পাওয়া যায়। ডায়েটে প্রতিদিন বায়োটিন সমৃদ্ধ খাবার রাখার মাধ্যমে চুল পড়া কার্যকর ভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
বিটা ক্যারোটিন
রুক্ষ, অমজবুত চুলের উজ্জ্বলতা ফেরাতে একটি প্রয়োজনীয় এন্টিঅক্সিডেন্ট হচ্ছে বিটা ক্যারোটিন। বিটা ক্যারোটিন হলো একধরনের পিগমেন্ট, যা শাকসবজিতে উপস্থিত থাকে বলে সেগুলো রঙিন হয়। শীতের এই সময়টিতে সহজলভ্য রঙিন শাকসবজি থেকে আমরা বিটা ক্যারোটিন পেতে পারি। গাজর বিটা ক্যারোটিনের সবচেয়ে ভালো উৎস। সবজির মধ্যে ব্রকলি, মিষ্টি আলু, মিষ্টিকুমড়া, শালগম, মটরশুঁটি, বাঁধাকপি, লাল ও হলুদ ক্যাপসিকাম, পার্সলেপাতা, লেটুসপাতা ইত্যাদিতে বিটা ক্যারোটিন রয়েছে।
দেশীয় ফলের মধ্যে আম, তরমুজ, পাকা বরই, বাঙ্গি, বেরিজাতীয় ফল ইত্যাদি বিটা ক্যারোটিনের উল্লেখযোগ্য উৎস।
পর্যাপ্ত পুষ্টির জন্য এসব শাকসবজি উচ্চ তাপে রান্না না করে অল্প তাপে সামান্য রান্না করে অথবা সম্ভব হলে সালাদ করে খেতে হবে। দৈনিক ডায়েটে এক থেকে দুইটি রঙিন শাকসবজি এবং ফলমূল অন্তর্ভুক্ত করলে বিটা ক্যারোটিনের চাহিদা অনেকটা নিশ্চিত করা যায়।
জিংক
শরীরে জিঙ্কের অভাব দেখা দিলে চুল ঝরতে পারে। সুতরাং ডায়েটে জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার রেখে চুলের হারানো ঘনত্ব ফিরে পাওয়া সম্ভব কারণ জিংক চুলের গোড়া মজবুত করতে সাহায্য করে। জিংক সমৃদ্ধ খাবারের সহজলভ্য উদাহরণ হচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের বীজ যেমন কুমড়ো বিজ, সূর্যমুখী বিজ, অর্গান মিট, লাল মাংস, মটরশুঁটি, ছোলা এবং মাশরুম। রোজকার ডায়েটে ডাল রাখলে জিঙ্কের ঘাটতি পূরণ হয়। ডাল জিংক এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ একটি সহজলভ্য খাদ্য উৎস। চুল পড়া রোধে ডায়েটে রাখা যায় ডার্ক চকোলেট, যার মধ্যে জিংক উল্লেখযোগ্য হারে বিদ্যমান।
আয়রন
মহিলাদের মধ্যে আয়রনের ঘাটতি সবথেকে বেশি দেখা যায়। রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম হলে, আয়রনের ঘাটতির কারণ হতে পারে। আয়রনের অভাব দেখা দিলে লোহিত রক্তকনিকার উৎপাদন ব্যহত হয় এবং অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায়। ফলে হেয়ার ফলিকলে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে না বলে চুল উঠতে থাকে। এ অবস্থায় সাধারনত মাথার উপরের অংশ থেকে চুল উঠতে থাকে। অবস্থা প্রকট হলে টাক পরে যাবার সম্ভাবনা পর্যন্ত দেখা দেয়। তাই চুলের বৃদ্ধি ও নতুন চুল গজানোর ক্ষেত্রে আয়রনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সবুজ পাতা জাতীয় শাক বিশেষ করে কচু শাক, কলমী শাক, লাল শাক আয়রনের উল্লেখযোগ্য খাদ্য উৎস। লাল মাংস, গরু কিংবা মুরগির কলিজা, ডাল, কলা, জাম, কাজুবাদাম ইত্যাদি খাবারেও যথেষ্ট পরিমাণে আয়রন থাকে। খাবার থেকে উদ্ভিজ্জ আয়রন শোষণের জন্য খাবারের সাথে ভিটামিন-সি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স
চুলের বিভিন্ন সমস্যায় বি গ্রুপের ভিটামিন অত্যন্ত কার্যকর। চুল ঘন এবং মজবুত করতে সাহায্য করে বি ভিটামিন। নতুন চুলের কোষ গঠনে কাজ করে থাকে ভিটামিন-বি৭ এবং ভিটামিন বি১২। চুল পাতলা হওয়া প্রতিরোধের পাশাপাশি চুলের উজ্জ্বলতা বাড়াতেও সমান উপযোগী এই গ্রুপের ভিটামিন। বি-ভিটামিন সমৃদ্ধ খাদ্য উৎস হচ্ছে মাংস, দুধ, দুধের তৈরি খাবার যেমন পনির, দই। এছাড়া ডিম, মাছ, ঝিনুক, পালং শাক, বিট, মাশরুম ,অ্যাভোকাডো, মটরশুটি, বিভিন্ন বিন, সয়া পণ্য ইত্যাদিতে বি-ভিটামিন থাকে।
কোলাজেন
চুলের পরিচর্যায় কোলাজেন নামক প্রোটিনের ভূমিকা অনেক। চুলের গোড়া মজবুত করতে বেশ উপকারী এই প্রোটিন। মানুষের শরীরেই কোলাজেন তৈরি হয় তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে কোলাজেনের ঘাটতি শুরু হয়। সুতরাং শরীরে কোলাজেনের প্রোডাকশন ঠিক রাখতে ডায়েটে এমন খাবার যোগ করতে হবে যেগুলি কোলাজেন তৈরিতে সাহায্য করে৷ কোলাজেন বৃদ্ধিতে সহায়ক খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সেলফিশ অর্থাৎ খোলস আবৃত মাছ, প্রানীর হাড় থেকে তৈরি ব্রথ, প্রানীজ আমিষ, ডিমের সাদা অংশ, ডেইরি প্রোডাক্টস, সাইট্রাস ফল।
হেলদি ফ্যাট
ফ্যাটি খাবার নিয়ে অনেকের মধ্যে দ্বিধাদন্দ কাজ করে, অনেকে মনে করেন ফ্যাটি খাবার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। তবে চুলের যত্নে হেলদি ফ্যাট খুব ভালো কাজ করে থাকে। হেলদি ফ্যাট বলতে বোঝায় ওমেগা-৩, ওমেগা-৬ এর মতন ফ্যাট। ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার চুল পড়া রোধ করে নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে। সামুদ্রিক মাছ থেকে প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়। সামুদ্রিক মাছের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রুপচাঁদা, লৈইট্টা, লাক্ষা, কোরাল, বিভিন্ন শুঁটকি মাছ। বিভিন্ন বাদাম, অলিভ ওয়েল, চিয়া সিড এবং ফ্ল্যাক্সসিড এও পর্যাপ্ত পরিমাণে হেলদি ফ্যাট পাওয়া। চুল পড়া বন্ধে সপ্তাহে ২-৩ দিন ডায়েটে সামুদ্রিক মাছ রাখা জুরুরি।
প্রোটিন
চুল পড়া রোধে দৈনিক খাবারের তালিকায় যে খাদ্য উপাদান না রাখলে নয় সেটি হচ্ছে প্রোটিন। চুলের গোড়া মজবুত করতে প্রোটিন খুবই দরকারি একটি খাদ্য উপাদান। শীতকালে যাদের চুল পড়ছে তারা প্রোটিন জাতীয় খাবারের দিকে বিশেষ নজর দিবেন। এক্ষেত্রে প্রানিজ আমিষ গ্রহণ করতে হবে। অনেকে আজকাল উদ্ভিজ্জ আমিষ গ্রহণে বেশি আগ্রহী এবং তুলনামূলক প্রানিজ আমিষ কম গ্রহণ করে থাকেন, ফলে দেহে এসেনশিয়াল অ্যামাইনো এসিডের অভাব দেখা দেয়। যার ফলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয় যার মধ্যে চুল পড়া অন্যতম। তাই প্রানিজ আমিষ নিশ্চিত করতে ডায়েটে রাখতে হবে ডিম, মাছ, মুরগি, টকদই, সর ছাড়া দুধ বা দুধের তৈরি খাবার।
এছাড়া চুলের সার্বিক সুস্থতায় ডায়েট হতে হবে ব্যালান্সড। ব্যালান্সড এবং হেলদি ডায়েট ফলো করার মাধ্যমে যে কোন জটিলতাই সহজে সমাধান করা সম্ভব। ডায়েট হতে হবে বৈচিত্র্যময় খাবারের সমন্বয়ে সঠিক ভাবে তৈরি। ডায়েটে রাখতে হবে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান, শীতকালীন মৌসুমি শাকসবজি এবং ফলমূল।
Writer:
Monia Mourin Mumu
Fitness Nutritionist